সম্প্রতি বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে একটি প্যাণ্ডেলে কুরআন শরীফ পাওয়াকে কেন্দ্র করে পূজা মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ী-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে, এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি কমিউনিটি।
অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি হিন্দু কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বকারী ২৪টি সংগঠনের যৌথ বিবৃতি
এসবিএস বাংলার কাছে পাঠানো অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি হিন্দু কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বকারী ২৪টি সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ইসলামী চরমপন্থীরা এই উৎসব জুড়ে হিন্দুদের উপর আতঙ্ক ছড়ায়। এর মধ্যে রয়েছে হিন্দুদের হত্যা, মহিলাদের ধর্ষণ, হিন্দুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া, দেবীর মূর্তি ভাঙচুর এবং মন্দিরের অপমান করা।
ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতিতে আরো বলা হয়, কুষ্টিয়ায় ২২শে সেপ্টেম্বরের শুরুতে দেবী মূর্তির ব্যাপক ভাঙচুর শুরু হয়, এরপর জয়পুরহাট, চট্টগ্রাম এবং এমনকি রাজধানী ঢাকায় বারবার হামলা হয়। ১২ অক্টোবর কুমিল্লায় পবিত্র কোরআনের অবমাননার অভিযোগের ভিত্তিতে একটি পূজা মণ্ডপে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থকরা হিন্দু মন্দির, বাড়িঘরে এই আক্রমণ চালানো হয়।
বিবৃতিতে বাংলাদেশে হিন্দুদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার জন্য বেশ কিছু দাবীর কথা বলা হয় যার মধ্যে আছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হামলার একটি সম্পূর্ণ, নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্ত শুরু এবং ফলাফল প্রকাশ, অপরাধীদের বিচারের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ক্ষতিগ্রস্ত ধর্মীয় স্থান, বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্নির্মাণ।
অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি পেশাজীবী, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের প্রতিক্রিয়া
এসবিএস বাংলার কাছে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলার ঘটনার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি পেশাজীবী, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ।
ক্যানবেরার কমিউনিটি সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধা কামরুল আহসান খান বলেন যে, পুরো ঘটনায় তিনি হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। তিনি মনে করেন এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দাঁড় করতে হবে।
তিনি তার তরুণ বয়সের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, স্বাধীনতার পূর্বে যখন এমন ঘটনা ঘটেছিলো, তখন সব দলের নেতা-কর্মীরা মিলে তা প্রতিরোধ করেছিল।
সিডনি নিবাসী কলামিস্ট এবং সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত মনে করেন, এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় বলে পার পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
তিনি তার কৈশোরের শুরুতে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও একইভাবে মূর্তি ভাঙার ঘটনা মনে করে বলেন, "সেটিকে আমরা ষড়যন্ত্র বলেছি, তারপর দফায় দফায় বিভিন্নভাবে হামলা হয় ঠিকই, কিন্তু পূজামণ্ডপে এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা এবং তাকে কেন্দ্র করে লাগাতার যে সাম্প্রদায়িকতা, অনাচার, তাণ্ডব, হত্যা, ধর্ষণ - এটা খুবই একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি।"
তিনি বলেন, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এটা চায় নি, যারা চেয়েছে তারা যে রাজনীতির সাথে জড়িত এবং প্রশাসনের প্রশ্রয়ে করেছে, তা পরিষ্কার।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মেলবোর্নের ড. চঞ্চল খান তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, এই ঘটনাকে কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও তার কাছে বিচ্ছিন্ন নয়।
আগেকার সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, এইসব ঘটনা প্রবাহ অনেকদিন ধরেই সিস্টেমেটিক রূপ পেয়ে আসছে।
মি. খান বলেন, "বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেক্যুলারিজমের ওপর ভিত্তি করে, কিন্তু এখন আমরা সাম্প্রদায়িকতার যে চেহারা দেখছি তা হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা তো অবশ্যই, তার চেয়ে বড় কথা এটি বাংলাদেশের উপর হামলা, বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং স্বাধীনতার মূল যে স্তম্ভ তার উপর হামলা।"
তিনি বলেন, "বিষয়টা যেভাবে প্রচার পেয়েছে তাতে আমরা বিশ্বের কাছে মুখ দেখতে পারি না, এটা এতটা লজ্জার বিষয়। ... হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের কাছে আমাদের মাথা হেট্ হয়ে গেছে।"
মেলবোর্নের বাসিন্দা তাপস বর্মন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা নতুন নয়, এর আগে আমরা দেখেছি নাসিরনগর, রামু, তারাগঞ্জে একইরকম ঘটনা ঘটেছে, এবং তারই ধারাবাহিকতায় এবার তা আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে - কিন্তু এসব ঘটনার কোনটারই আসলে সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয় নি, কিংবা দোষীদের আইনের আওতায় আনা যায় নি, এটাই দুস্কৃতিকারীদের উৎসাহিত করেছে।
হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে মেলবোর্নের সানি সঞ্জয় বলেন, "এজন্য প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের উদ্বেগের সাথে কাটাতে হয়েছে দেশে আমাদের স্বজনদের কথা মনে করে। ... এ ধরনের ঘটনায় যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের আমি মন থেকে জানাই ধিক্কার।"
মি. সঞ্জয় বলেন, "১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আমরা হিন্দুরা নিজ দেশে পরাধীনই রয়ে গেছি, আর জিম্মি হয়ে আছি উগ্রবাদী ধর্মান্ধদের কাছে।"
তিনি বলেন, "আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে হিন্দুদের কোন বৈরিতা নেই, তাদের মধ্যে বরং সম্প্রীতি আছে।"
মি. সঞ্জয় অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলের নাম করে কতিপয় নির্দিষ্ট কিছু 'ধর্মগুরুরা' সাধারণ মানুষের মাথায় এই ধারণা ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে, 'হিন্দু হঠাও, ভারত পাঠাও, ... অথবা ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, হিন্দুদের নির্যাতন করে বেহেস্তের টিকিট পাওয়া যাবে' - আমরা কখনো দেখি নি যে এ ধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদ দমনের জন্য বাংলাদেশের কোন সরকার বা প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত এবং জাসাসের সংগঠক সিডনির আবিদা আসওয়াদ বলেন, ধর্ম হবে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্র হবে সবার।
'কুরআন অবমাননার' কথিত ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগাটাই স্বাভাবিক। পুলিশের গুলিতে অন্তত সাত জন নিহত হলে পুরো দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, পূজা উৎসব প্যান্ডেলগুলোতে হামলা হয়। তিনি বলেন, কিন্তু এই চেহারা বাংলার আসল চেহারা নয় - তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে এটি ঘটলো কীভাবে?
"তাহলে কি আমাদের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িক মানসিকতা বাড়ছে? ... গত কয়েকদিনে যে ঘটনা ঘটলো, ভাঙচুর, হতাহতের যে খবর আমরা পেয়েছি, তাতে আমি সত্যিই বাকরুদ্ধ! শুধু আমিই নই সাধারণ জনগণের কাছে প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ", বলেন মিজ আসওয়াদ।
সিডনি নিবাসী অমল দত্ত মনে করেন, বাংলাদেশের ২২টি জেলায় পরিকল্পিতভাবে এই হামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলাদেশ, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই হামলা করা হয়েছে।
মেলবোর্নের পীযুষ দত্ত বলেন, হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের সময় ইসলামী উগ্রবাদীদের হামলা সারাদেশে উৎসবের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, "এই সাম্প্রদায়িক হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত নয় বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর প্রায় ৩,৬৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একটি ঘটনারও সুবিচার হয় নি।"
মি. দত্ত বাংলাদেশি হিন্দুদের রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আন্তরিক অনুরোধ জানান।
সিডনির সুরজিৎ রায় বলেন, এই ঘটনার পর আমরা বাংলাদেশে টিকে থাকা নিয়ে চিন্তিত, আমাদের আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশে যারা আছে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা শংকিত।
আগের বিভিন্ন ঘটনার উদাহরণ টেনে মি. রায় বলেন, সব জায়গায় একেকটা ঘটনা তৈরী করা হয়, এগুলো ঘটাবার জন্য কিছু কুশীলব সবখানেই আছে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, "বাংলাদেশে কোন হিন্দুর কোন সাহস হবে কি একটা কুরআন শরীফ নিয়ে কোন মন্দিরে বা দেবতার কাছে রাখা? সংখ্যালঘু বা হিন্দু সম্প্রদায়ের যারাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত তারা এভাবে গড়ে উঠে নি যে, তারা অন্য ধর্মের অবমাননা করবে।"
মেলবোর্ন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত মোল্লা রাশিদুল হক বলেন, "আমি মনে করি না হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি এই কাজে জড়িত, যদি যুক্তির খাতিরে ধরেও নেই যে, কেউ জড়িত, তার জন্য দেশে আইন আছে, পুলিশ-গোয়েন্দা সংস্থা আছে, তারা এর সত্যতা বের করবে এবং অপরাধীকে আইনের আওতায় আনবে, এটাই হওয়া উচিত।"
হামলার ঘটনা উল্লেখ করে মি. হক বলেন, "দেশের আইন না মেনে, এধরনের অরাজকতা সৃষ্টি, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলা, কখনোই এগুলো মেনে যায় না, কোন দেশেই না। এমনকি শতভাগ শরীয়ত মানা কোন সরকারও কিন্তু এটা মেনে নেবে না, কারণ তাদের দায়িত্ত্ব সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান করা।"
সিডনি নিবাসী এবং বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত মনিরুল হক জর্জ বলেন, বাংলাদেশের যে এই ঘটনা তা অত্যন্ত দুঃখজনক, বাংলাদেশ সকল ধর্মের মানুষের দেশ।
তিনি বলেন, "এটা কোন ধর্মপ্রাণ হিন্দু বা মুসলমান করবে না, এটা হয়তো কোন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাজ। তারা দেশকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে এটা করেছে ... যারাই এটা করেছে, আমি তাদের ধিক্কার জানাই।"
মি. জর্জ বলেন, সরকার বা পুলিশ প্রশাসনেরও এক্ষেত্রে গাফিলতি বা ব্যর্থতা ছিল।
পুরো প্রতিবেদনটি বাংলায় শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারে ক্লিক করুন।
Follow SBS Bangla on FACEBOOK.