অস্ট্রেলিয়ার বিচার ব্যবস্থা অনেকের কাছে ব্যয়বহুল, বিভ্রান্তিকর আর জটিল মনে হতে পারে। সেটলমেন্ট গাইডের এই পর্বে আমরা দেখবো কোথায় আর কিভাবে সুলভে এবং বিনামূল্যে আইনী সহায়তা পাওয়া যায় ।
- আইন সহায়তাকারী সংস্থাসমূহ আবেদনকারীর সার্বিক অবস্থা আর মামলার ধরন অনুযায়ী সহায়তা করে থাকেন।
- আইনী সহায়তার জন্য আর্থিক অনুদান পেতে হলে আবেদনকারীকে '''মিন্স এন্ড মেরিট টেস্ট' পাস করার পাশাপাশি আইন সহায়তা কমিশনের মানদণ্ডেও উপযুক্ততা প্রমাণ করতে হয়।
- ন্যাশনাল লিগ্যাল এসিস্ট্যান্স পার্টনারশিপ এর আওতায় ২০২০-২৫ সালে আইনী সহায়তা খাতে ২.৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল বরাদ্দ করা হচ্ছে।
সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি যাদের আইনি সহায়তা দরকার, তারা নিজ নিজ রাজ্যের সরকারি আইন সহায়তা কমিশন বা লিগ্যাল এইড কমিশনের কাছে সহায়তা চাইতে পারেন। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য সরকারী এই সংস্থা ছাড়াও স্থানীয় কমিউনিটি লিগ্যাল সেন্টার এবং এবরিজিন এন্ড টরে' স্ট্রেইট আইল্যান্ডার লিগ্যাল সার্ভিসে বিনামূল্যে আইনী সাহায্য পাওয়া যায়।
মোনাশ ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ের অধ্যাপক ডক্টর জেফ জানান, আইন সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে থাকে। কেবলমাত্র উকিল নিয়োগ নয়, সালিশ বা বিবাদ সমাধানের প্রাথমিক আলোচনাতেও তারা সাহায্য করে থাকে। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা বেছে বেছে মামলা গ্রহণ করেন।
এইসব আইনী সহায়তা কেন্দ্রে শুরুতে আবেদনকারীর আর্থিক অবস্থা এবং তার মামলার পর্যালোচনা করা হয় যাকে মিন্স এন্ড মেরিট টেস্ট বলা হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে বাদীপক্ষের মামলার ধরন পারিবারিক, ফৌজদারি নাকি দেওয়ানী মামলা তা আমলে নেওয়ার পাশাপাশি তার আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা করা হয়।
অনেকের হয়তো কোন মামলায় কেবল আইনি পয়ামর্শ দরকার বা কোন তথ্যের দরকার— এসব ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা কেন্দ্র পরামর্শ দিয়ে থাকে। কিন্তু যদি কারোর উকিল নিয়োগের দরকার হয়, সেক্ষেত্রে তাকে আর্থিক সহায়তার জন্যও আবেদন করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার মধ্যম আয়ের বেশিরভাগ ব্যক্তিই আইনী সাহায্য তহবিল পাওয়ার উপযুক্ত নন বলে জানিয়েছেন সিডনী ইউনিভার্সিটির আইন অধ্যাপক সিমন রাইস। অস্ট্রেলিয়ায় জুলাই ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত আইনী সহায়তার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেছেন, এই খাতে সরকারি তহবিলের ৬৫ ভাগ গ্রহীতা ছিলেন পুরুষ আর ৩৩ ভাগ নারী।
অস্ট্রেলিয়াজুড়ে ১৭০টি স্বাধীন, অলাভজনক কমিউনিটি লিগ্যাল সেন্টার বিনামূল্যে আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে; তার মধ্যে আছে তথ্য সহায়তা ও পরামর্শ , আইনী শিক্ষা, উকিল নিয়োগ কেসওয়ার্ক এবং রেফারাল।
অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক আইন কেন্দ্রসমূহের শীর্ষ সংগঠন কমিউনিটি লিগ্যাল সেন্টারস অস্ট্রেলিয়ার সিইও নাসিম আরাগে বলেন, কমিউনিটি ভিত্তিক আইন কেন্দ্রগুলো বিভিন্নভাবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সম্প্রদায়কে আইনী সাহায্য দিয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন নামে কাজ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে।
ডক্টর আরাগে জানান, মামলার ধরন বিবেচনা করে কমিউনিটি লিগ্যাল সেন্টারগুলো আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে। একেকজনের পরিস্থিতি অনুযায়ী সাহায্যের ধরনে রকমফের হয়ে থাকে।
চেষ্টা করা হয় সব পরিস্থিতি বা সব ধরনের প্রয়োজন বিবেচনা করে সহায়তা করার; কারোর হয়তো ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা কম, কেউ হয়তো প্রতিবন্ধী ইত্যাদি।
কমিউনিটি লিগ্যাল সেন্টারগুলোতে যারাই যোগাযোগ করুক, সবাই যাতে অন্তত তথ্য পেতে পারেন এবং সেখানে থাকা সেবাগুলো নিজে নিজে খুঁজে পেতে পারেন, তার চেষ্টা করা হয়।
মারিয়া ছদ্মনামে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত নারী এসবিএস রেডিওকে জানান, তিনি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন।
আইনী সাহায্যের জন্য তিনি লিগ্যাল এইড এনএসডব্লিউ সহ আরও বিভিন্ন কমিউনিটি আইন সহায়তা কেন্দ্রের সাহায্য নিয়েছিলেন।
উইমেন্স লিগ্যাল সার্ভিস ভিক্টোরিয়া ব্যক্তিগত সম্পর্কজনিত জটিলতা বা সহিংসতার শিকার দুস্থ নারীদের বিনামূল্যে আইনী সহায়তা দিয়ে আসছে।
তহবিল সংকট থাকায় তারা খুব অল্প সংখ্যক নারীদের সাহায্য করতে পারছেন বলে স্বীকার করেন, সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেলেন ম্যাথুস। তবে তারা সাহায্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকেন। তাদের উল্লেখযোগ্য সেবার মধ্যে উকিল নিয়োগ অন্যতম। তিনি জানান,
মেলবোর্ন মেজিস্ট্র্যাট কোর্টে মামলা পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে উকিল নিয়োগ করে আমরা আইনী সহযোগিতা করে থাকি।
এছাড়াও সারাদেশে স্থানীয় কোর্ট এবং ট্রাইব্যুনালে যে কেউ সেখানকার কর্মরত আইনজীবী বা ডিউটি ল'ইয়ারের কাছে বিনামূল্যে সহায়তা নিতে পারেন।
সেখানে উকিলের সহায়তা বিনামূল্যে পাওয়া যায় কিন্তু সহায়তার পরিধি সীমিত। যদি কোর্টে কোন মামলা থাকে আর কারোর পক্ষে মামলা লড়ার জন্য কোন উকিল না থাকেন তখন ডিউটি ল'ইয়ারের সাহায্য নেওয়া যায়। জটিল মামলার ক্ষেত্রে বর্ধিত কর্মদিবসে ডিউটি লইয়ারের সাহায্য পাওয়া যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে কোর্টে হাজিরা দিতে হলে অবশ্যই তা আইন পেশাজীবির মাধ্যমে হতে হবে। এই ধরনের মামলা আইনজীবীর মাধ্যমে কোর্টে রিপ্রেজেন্ট করা আবশ্যক।
অবশ্য পারিবারিক এবং দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে নিজে মামলা নিজে মামলা লড়া যায়। এক্ষেত্রে কোর্ট রিপ্রেজেন্টেশন ব্যক্তি নিজে করতে পারেন।
সিডনী ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক সিমন রাইস এর মতে, কোর্টে নিজের মামলা লড়ার মত ব্যবস্থা থাকলেও আপনার কোর্টের দলিল তৈরির এবং কোর্টে নিজের যুক্তি তুলে ধরার মত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা আবশ্যক।
আইন অধ্যাপক ডক্টর জেফ গিডিংস জানান,
পারিবারিক মামলায় সহায়তা করতে মোনাশ ইউনিভার্সিটির ফ্যামিলি ল এসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম চালু আছে। এর মাধ্যমে নিজের মামলা লড়তে ব্যক্তি পর্যায়ে সহায়তা দেওয়া হয়।
এছাড়াও গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, ডেকিন ইউনিভার্সিটি, বন্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনগত সহায়তা দেওয়ার নিজস্ব ব্যবস্থা আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ পরিচালিত এসব আইন সহায়তাকেন্দ্রগুলোকে ল ক্লিনিক বলা হয়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ এবং যোগ্য আইনজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা দিয়ে থাকেন।
এছাড়াও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিচারব্যবস্থা বা কোর্টকাচারির কাজে তথ্য ও পরামর্শ পাওয়া যায়।
শুরুতে আমরা যার কথা বলছিলাম, মারিয়া, তার সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে মামলা লড়ে যাচ্ছেন।
মর্টগেজএ থাকা একটা বাড়ির আংশিক মালিকানা থাকায় তিনি রাজ্য আইন সহায়তা কেন্দ্রের মিন্স টেস্টে পাস না করেননি। তবে তাকে বিনামূল্যে তার পক্ষে লড়ার মত উকিলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলমান আছে।
উপরোক্ত সেবাদানকারী সংস্থা ছাড়াও অনেক দক্ষ আইনজীবী বিনামূল্যে আইন সহায়তা দিয়ে থাকেন। বিনামূল্যে পেশাদারী সেবা দেওয়া কে প্রো-বোনো সার্ভিস বলা হয়। এ ধরনের সেবা খুঁজতে অস্ট্রেলিয়ান প্রো-বোনো সেন্টার ওয়েবসাইট ভিজিট করুন ।
অস্ট্রেলিয়ায় লিগাল এইড বিষয়ক আরও তথ্যের জন্য এবং এসবিএস এর ইনভেস্টিগেটিভ সিরিজের জন্য এসবিএস ল্যাঙ্গুয়েজ ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
কোনো শিশু, অন্য কোনো ব্যক্তি কিংবা আপনি নিজে যদি গুরুতর কোনো বিপদের সম্মুখীন হন, তাহলে কল করুন 000 নম্বরে।
আপনি কিংবা আপনার পরিচিত কারও সহায়তার দরকার হলে ভিজিট করুন www.1800respect.org.au কিংবা কল করুন 1-800-737 732 নম্বরে।
প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।
Follow SBS Bangla on FACEBOOK.