সার্বিক সুস্বাস্থ্য লাভের জন্য নিজের যত্ন নেয়ার কোন বিকল্প নেই — এ কথা চিকিৎসা গবেষণা অনুযায়ী প্রমাণিত। কিন্তু সন্তান প্রতিপালন করতে হয় বা সংসারের কাজ সামলাতে হয় এমন ব্যস্ত নারীদের ক্ষেত্রে সেলফ কেয়ার সহজ নয়। কর্মজীবী নারীদের জন্য তা আরও কঠিন। আপনার কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনে কেন আর কিভাবে নিজের যত্ন নেবেন তা নিয়েই এবারের সেটলমেন্ট গাইড।
পূর্ণকালীণ কর্মজীবি ফাতিমা হাসে, লোগানে থাকেন। সংসার আর চাকুরি একসাথে সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। নিজের কথা ভুলে শিশু সন্তান সহ সংসার আর কাজ সামলাতে তার দিন কেটে যেতো।
জীবনের এই পর্যায়ে কিভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায় তা অনুধাবনে তিনি সপ্তাহব্যাপী এক আত্মউন্নয়ন কর্মশালায় যোগ দেন। সেখান থেকে নিজের যত্ন নেয়ার কথা, আত্মকল্যান আর সুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব তিনি উপলদ্ধি করতে পারেন।
ডক্টর মে লি উয়োং নারী স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক একটি অলাভজনক সংস্থা জিন হেইলি’জ ফর উয়মেন’স হেলথ এর ডাক্তার ।
তিনি নারী স্বাস্থ্য সপ্তাহ বা উইমেন’স হেলথ উইক ক্যাম্পেইনের অন্যতম একজন আয়োজক ও পরিবেশক।
নিজের যত্ন নেয়াকে তিনি অন্যকে অক্সিজেন মাস্ক পরতে সাহায্য করার পূর্বে নিজের নাকে দেওয়ার সাথে তূলনা করেন।
তার মতে অন্যকে সাহায্য করতে হলে আগে নিজেকে সাহায্য করতে হয়। নিজেকে ভালবাসতে হয়, যাতে পূর্ন উদ্যম আর দায়িত্ব নিয়ে সেই ভালবাসা পরিবার আর কমিউনিটিতে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি পরিচালিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ায় ৮০ শতাংশ হৃদরোগ, স্ট্রোক, টাইপ-2 ডায়াবেটিস এর মত রোগ এমনকি দেশের এক তৃতীয়াংশ ক্যান্সার নিজের সুস্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার মাধ্যমেই রোধ করা যায়।
রোগ প্রতিরোধসহ সুস্বাস্থ্য রক্ষায় নিজের যত্ন নিতে হলে নিয়মিত শরীর চর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ জরুরী এবং সেই সাথে এলকোহল ও ধূমপানও ত্যাগ করতে হবে। ডক্টর উয়োং এর মতে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় শরীরের সাথে সাথে মনের যত্ন নেয়াও জরুরী।
অনেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মানসিক সমস্যার কথা প্রকাশ্য আলোচনায় তুলতে চান না। তারা এসব তথ্য ডাক্তারের কাছ থেকেও গোপন করেন।
বিয়ন্ড ব্লু সংস্থার প্রধান ক্লিনিক্যাল এডভাইজর ডক্টর গ্রান্ট ব্লাশকির এসব বিষয়ে নিজের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বলেন,
অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক তাদের জীবনে কখনো না কখনো মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখিন হন।
তাদের মধ্যে প্রতি বছর অন্তত এক মিলিয়ন মানুষ বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন এবং দুই মিলিয়ন উদ্বিগ্নতা বা এংজাইটিতে ভোগেন।
ব্রিসবেনের বাসিন্দা দুই সন্তানের জননী মারসেলা তার প্রথম সন্তান জন্মদানের পর পোস্ট-নাটাল ডিপ্রেশনে ভুগেছিলেন। ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা আক্রান্ত মার্সেলার জীবনের সব রঙ যেন ফিকে হয়ে গিয়েছিল। সচতনভাবে রুটিন মেনে নিজের যত্ন নেওয়ার কিছু কাজ করার মাধ্যমে সেই বিষণ্ণতার অসুখ তিনি দূর করেছিলেন।
বিষাদ দূর করতে মারসেলা বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। যেসব কর্মকাণ্ডে মন প্রফুল্ল হয়, শরীর চাঙ্গা হয় —যেমন নিয়মিত মেনিকিউর, পেডিকিউর, ম্যাসাজ নেওয়া বা হাঁটাহাঁটি করা; এসব ছাড়াও কোন ব্যস্ত দিনের শেষে তিনি মেডিটেশনের চর্চা করতেন।
কখনোবা আর কিছু নয়, ১০-১৫ মিনিট ধরে শুধুই চা পান উপভোগ করতেন যাতে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে ভিন্ন রকম মনে হয়।
অনেক সময় ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে নারীদের নিজের মনের কথা খুলে বলতে সমস্যা হতে পারে।
এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে ডক্টর উয়োং বলেন,
সার্বিক সুস্বাস্থ্য লাভের পথে সংস্কৃতির ভিন্নতা অনেক সময় সমস্যা তৈরি করতে পারে। যদি সাংস্কৃতিভাবে সক্ষম বা কালচারালি কমপিটেন্ট কোন ডাক্তার বা পেশাদার সেবাদানকারী না থাকে, তবে নারীরা মন খুলে কথা বলবেন কিভাবে?
মারিয়া হাচ মাল্টিকালচারাল সেন্টার পর উইমেন’স হেলথ এর সিনিয়র পলিসি এডভাইজর।
তার মতে, সেলফ কেয়ার এর মানে একেক জনের কাছে একেক রকম। তার কারণ, প্রত্যেকের নিজস্ব বাস্তবতা বা পরিস্থিতির ভিন্নতা রয়েছে।
যে সংসারে নির্যাতন হয়, সেখানে নিরাপদে থাকাটাও আসলে সেলফ কেয়ার বুঝায়। প্রচন্ড কর্মব্যস্ততায় কিছু অবসর খুঁজে পাওয়া অনেকের কাছে সেলফ কেয়ার।
সোজা কথায় বলা যায়, সেলফ কেয়ার মানে নিজেকে ভালবাসা, নিজেকে সময় দেওয়া। চারপাশের আবর্তনশীল ব্যস্ত জীবনে নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়া। সবখানে যাওয়ার ফাঁকে নিজের কাছে যাওয়া। অনেক সময় নিঃসঙ্গ জীবনে সঙ্গ লাভ। সকলের মাঝে উষ্ণতা, ভালবাসা খোঁজ।
এক্ষেত্রে কমিউনিটি বা সমাজের সাথে অন্তরঙ্গতার ভূমিকা অনস্বিকার্য। মিস হাচের গবেষনায় দেখা যায়, সেলফ কেয়ার এর সাথে কমিউনিটি কেয়ার অনেক দিক দিয়েই সম্পর্কিত। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তির সমন্বয়েই স্বাস্থ্যকর সমাজ গড়ে উঠে।
নিজের যত্ন নেবার বিভিন্ন কাজ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে শিখেছেন ফাতিমা হাসে। সেই উদ্যোগ নেবার পর দু বছর পেরিয়ে গেছে।
এর মধ্যে তিনি শরীর থেকে ওজন ১০ কেজি কমিয়েছেন । শুধু শরীরের ভার নয়, এর মধ্যে তিনি যেন মনের ভার থেকেও মুক্ত হয়েছেন। আজ তিনি সম্পুর্ন নতুন এক মানুষ।
এখন তিনি নিজেকে শতভাগ নিবেদিত করতে পারেন যে কোন কাজে। এখন তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, নিয়মিত জিমে যাচ্ছেন, আর প্রতিদিন আধ ঘন্টা ধরে নতুন কিছু শিখতে মনোনিবেশ করছেন। এইসব কিছুই তিনি করছেন তার তিন ছেলেকে কোভিড-১৯ লক ডাউনে নিয়মিত পড়ানোর পর আর একজন রিলেশনশিপ কোচ হিসাবে নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পর।
৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় নারী স্বাস্থ্য সপ্তাহে নিজের যত্ন নেওয়ায় অগ্রাধিকার দিন।
এই বিষয়ে আরও জানতে আর সেলফ কেয়ার টিপস পেতে ভিজিট করুন www.womenshealthweek.com.au
মানসিক বা আবেগীয় সাহায্য পেতে হলে কল করুন বিয়ন্ড ব্লু তে ,
দিনের যে কোন সময় তাদের হেল্প লাইন নাম্বারে — ১৩০০ ২২ ৪৬ ৩৬
বিনা খরচে যে কোন অনুবাদ সাহায্য পেতে ট্রান্সলেটিং এন্ড ইন্টারপ্রেটিং সার্ভিসে কল করুন ১৩১৪৫০ নাম্বারে এবং আপনার নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী সেবাদানকারী কথা জানান।
এছাড়া পারিবারিক ও যৌন নিপীড়নে সাহায্য পেতে হলে কল করুন ১৮০০ রেসপেক্ট বা ১৮০০ ৭৩৭ ৭৩২
জরুরী বা আশু বিপদে সাহায্যের জন্য কল করুন ০০০ ( ত্রিপল জিরো )
Follow SBS Bangla on FACEBOOK.
আরও দেখুন: