তবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাল্টে দেয়া এই ঘটনার প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছিল বেশ আগে। অভ্যুত্থানের কারণ নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা এবং বিভ্রান্তি থাকলেও সামরিক বাহিনীর তৎকালীন বেশ কিছু কর্মকর্তা মনে করেন, ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই সামরিক বাহিনীতে 'চেইন অফ কমান্ড' ভেঙে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল। আর তার পরিণতিই হচ্ছে নভেম্বরের সেই ঘটনাপ্রবাহ।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে কতিপয় সেনা সদস্য কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে যা 'জেল হত্যা' নামে পরিচিত। সেসময় বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকলেও বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর অনেক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজন মেজর যা ছিল 'চেইন অফ কমান্ড' ভেঙে পড়ার প্রত্যক্ষ উদাহরণ।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন তখন ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের মেজর পদমর্যাদার স্টাফ অফিসার ছিলেন। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন যে, ১৫ই অগাস্টের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে সরিয়ে দেয়ার পর জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলে খালেদ মোশাররফের সাথে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অক্টোরের শেষ দিকে তারা অনেকটা খোলামেলাভাবেই শুনতে পাচ্ছিলেন, কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
বিবিসি বাংলার একই প্রতিবেদনে কে এম শফিউল্লাহ বলেছিলেন যে, ১৫ই অগাস্টের পর তিনি অনেকটা গৃহবন্দী হিসেবেই সেনাপ্রধানের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে যে একটি উত্তেজনা রয়েছে সেটি তিনি টের পাচ্ছিলেন।
নভেম্বরের ৪ তারিখের প্রথম প্রহরেই খালেদ মোশাররফের নেতৃ্ত্বে একটি অভ্যুত্থানে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়।
এদিকে এই ঘটনা যখন ঘটছিলো তখন দৃশ্যপটে আসে কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের গণবাহিনী। গণবাহিনী যখন ৬ তারিখ সন্ধ্যায় পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তার পরদিন ৭ই নভেম্বর দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা মুক্ত করেন জিয়াউর রহমানকে।
৭ই নভেম্বর সকালেই ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল কে এন হুদা এবং লেফটেনেন্ট কর্ণেল এ টি এম হায়দারকে। এই পাল্টা অভ্যুত্থানেই বস্তুত ক্ষমতায় আসীন হন জিয়াউর রহমান এবং শুরু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়।
এ প্রসঙ্গে এসবিএস বাংলাকে রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, "৭ই নভেম্বরের ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার যে রাজনীতি সেটি শুরু হয়।"
৭ই নভেম্বরের ঘটনাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল 'সিপাহী-জনতা সংহতি দিবস' কিংবা 'মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস' নামে অভিহিত করে। আর এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দুটি ভিন্ন ধারা।