বাংলাদেশে সম্প্রতি ধর্ষণের সাজা সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০’ এর নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
এই সংশোধিত অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় এটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনে পরিণত হলো। এখন নিয়ম অনুযায়ী সংসদ অধিবেশন শুরু হলে এটি আইন আকারে পাস হবে।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী ৯ (১) উপধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে গত ৪ অক্টোবর নোয়াখালীতে এক নারীকে (৩৭) বিবস্ত্র করে নির্যাতনের এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। জড়িতদের অধিকাংশকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনেরবিরুদ্ধে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন, “আইনের সংশোধন অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার সুযোগ থাকায় ধর্ষণের মতো অপরাধ কমে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে কি বাংলাদেশে ধর্ষণ কমবে?
নতুন এই অধ্যাদেশ জারির পর এখন কি ধর্ষণ কমবে? এ সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ জাকির হোসেন এক সাক্ষাৎকারে এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“যদি শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়, যেমন, মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে; মৃত্যুদণ্ড করলেই যে আপনার অপরাধ সমাজ থেকে কমে যাবে, এমন কোনো নজীর খুব যে আছে তা আমি বলতে পারি না।”
“তবে হ্যাঁ, এটা এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে।”
“কিন্তু, আমার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষে শিশু ধর্ষণের জন্য ইতোমধ্যেই শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু আমি কোনো পরিসংখ্যানে এ পর্যন্ত পাই নি যে, মৃত্যুদণ্ড করার কারণে ভারতবর্ষে ধর্ষণের পরিমাণ কমে গেছে।”
ধর্ষণের মতো অপরাধ দূর করতে হলে এই সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সমস্যা দূর করার প্রতিও জোর দেন তিনি।
অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন,

Protesters blocked Shahabag intersection in Dhaka, demanding the realization of their nine-point demand and protest against recent alleged rape. Source: AAP Image/Nahid Hasan/Pacific Press/Sipa USA
“এটা সত্যি নয় যে, শুধুমাত্র সাম্প্রতিক কালেই ধর্ষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা পুরোপুরিভাবে সত্য নয়। ধর্ষণ আগেও হয়েছে। এখন কিছু তোলপাড় করা ঘটনা ঘটেছে।”
সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের কথা তুলে ধরেন এবং “বিশেষ করে এই সময়ে মোবাইল ফোনে পর্ন ছবির সহজলভ্যতা”-কে তিনি অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেন। এ ছাড়া, মাদকের বিস্তার, ধর্ষণ-সংশ্লিষ্ট আইনের সীমাবদ্ধতার কথাও বলেন তিনি।
“এই যে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে ভয়ঙ্কর রকমের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারহীনতা রয়েছে।”
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মামলা ও বিচার যাতে না হয় সেজন্য প্রভাবশালী মানুষেরা আপোস-রফা করার চেষ্টা করে থাকে।
বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা কোনো সাজা পাওয়ার ভয় করে না, বলেন তিনি। তার মতে,
“এ রকম একটা মানসিকতা থাকলে সমাজে শুধু ধর্ষণ না, অন্য যে-কোনো রকমের অপরাধ বৃদ্ধি পায়।”
অধ্যাপক জাকির হোসেন প্রশ্ন তোলেন,
“যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যখন ছিল, তখন সাজার পরিমাণ কতো ছিল? এক হাজার জনে মাত্র সাড়ে চার জন।”
“বার্ষিক এ সমস্ত (মামলার) নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩.৬৬ শতাংশ। এ রকম যদি হয়, যদি আপনি বিচার করতে না পারে, বিচারই হচ্ছে না যেখানে, যেখানে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে, তাহলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে কী হবে?”
তার মতে, শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করার কারণে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বন্ধ হবে না।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকেও এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশে নারীদের প্রতি সহিংসতার সমাধান নয়।
এদিকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার প্রধান মিশেল ব্যাচলেট আপত্তি জানিয়েছেন বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি বলেছেন, ধর্ষণ জঘন্য অপরাধ হলেও তাতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যথাযথ কোনও শাস্তি নয়।