সোমবার রাতে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় ও চিনা সেনার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। প্রাথমিক ভাবে এক কর্নেল-সহ তিন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর কথা বলা হলেও রাতে ভারতীয় সেনার বিবৃতিতে জানানো হয়, গুরুতর আহত আরও ১৭ জন সেনা সদস্য প্রবল ঠান্ডার কারণে মারা গিয়েছেন।
নিহত কর্নেল সন্তোষ বাবু বিহার রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন।সোমবার রাতে গালোয়ান উপত্যকায় অতর্কিতে ভারতীয় সেনার উপর আক্রমণ চালায় চিনের সেনারা।ভারতীয় সেনার তরফে জানানো হয়েছে ,পারস্পরিক শান্তি চুক্তি মেনে সেনা সরিয়ে আনা হয়। সেনা সূত্রে খবর, গোলাগুলি নয়, পাথর, রড নিয়ে হামলা চালায় চিনের সেনারা।পাল্টা জবাব দেয় ভারতও। চিনের তরফে দাবি করা হয়েছে, তাদের ৫ জওয়ান নিহত হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরের খবরে বলা হয়েছিল, লাদাখে রীতিমতো যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চিনের সংবাদমাধ্যমেও বলা হয়েছে তাঁদের সৈন্যদেরও অনেকের প্রাণ গিয়েছে। নিহত ও আহত হয়েছেন চিনের প্রায় ৪৩ জন সেনা। জানা গিয়েছে, আহত ও নিহত চিনা সৈন্যদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে সীমান্তে হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে চিন সরকার।বিবৃতি জারি করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তি ফেরানোর জন্য সামরিক এবং কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা চালাচ্ছে দুই দেশ।
সেনা সূত্রের খবর, চিনের সঙ্গে সংঘর্ষ গুরুতর আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা। আহত অবস্থায় প্রবল ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করতে পারেনি তাঁরা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভারতীয় সেনারা। রাতে গোটা বিষয় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। চলতি সংঘাতের আবহে এই প্রথম ভারতের তরফে সরকারি ভাবে চিনের নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করা হল।
চিন সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত কোনও চিনা সেনার মৃত্যুর খবর জানায়নি। তবে, বেজিং প্রশাসনের মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস-এর প্রধান সম্পাদক টুইট করে জানিয়েছেন, গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষে চিনের সেনাও নিহত হয়েছেন। সোমবার, ১৫ জুন, রাতে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চিন সংঘর্ষে দু-পক্ষেরই একাধিক সেনা হতাহত হয়েছে। ভারতের তরফে বিহার রেজিমেন্টের এক সেনা অফিসার কর্নেল সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও, বেজিং কিন্তু ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও এ নিয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি। ফলে, চিনের ক'জন সেনা মারা গিয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে, অসমর্থিত একটি সূত্রে চিনের ৪০ জন সেনা জওয়ান হতাহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।
লাদাখে ভারত ও চিনের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত মে মাসের গোড়ায়। দারবুক থেকে দৌলত বেগ ওল্ডি বিমাণ ঘাঁটি পর্যন্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার সমান্তরালে যে রাস্তা ভারত তৈরি করছে, মূলত তা নিয়েই আপত্তি চিনের। পেট্রোলিং পয়েন্ট ১৪-এ শাইয়োক নদীর উপরে সেতু তৈরি ঠেকাতে ওই সময়েই পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা, নাকু লা এবং প্যাংগং লেকের উত্তর প্রান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকার কয়েক কিলোমিটার ভিতরে এসে তাঁবু গেড়ে বসে পড়ে চিনা সেনারা। তার পর থেকে মাঝেমধ্যেই সংঘাত হচ্ছে দু’পক্ষের।
অন্যদিকে, লাদাখে ভারত-চিন সংঘাতের কয়েক ঘণ্টা পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল, বা, এল এ সি -এর পরিস্থিতি এখন কী অবস্থায় রয়েছে, সেদিকে তাঁরা নিবিড় ভাবে নজর রাখছে।মার্কিন যুক্তরাষ্টের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ভারতীয় সেনা বাহিনীর ঘোষণা থেকে জানতে পেরেছেন ২০ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট মন্ত্রণালয়য়ের ওই মুখপাত্র বলেছেন, লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে ভারত-চিন উভয়পক্ষই তৎপর হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করছে।
এদিকে,পূর্ব লাদাখে গত দু’মাস ধরে চিনের নিরবচ্ছিন্ন চাপের মুখে ভারতের বিরোধীরা ধারাবাহিক ভাবেই প্রশ্ন তুলছিলেন, এত করে লাভটা কী হল? চিনের সঙ্গে সংঘর্ষ অন্তত ২০ জন সেনার মৃত্যুর পরে ,সাড়ে চার দশক পরে চিনের সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু, ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রশ্নটা আরও বাড়ছে। এমন অভিযোগও উঠছে, যতটা গর্জে ওঠার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা, তাঁর সরকার,তার ধার-কাছ দিয়েও যাচ্ছেন না। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের প্রশ্ন, ৫ মে-র পর থেকে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নীরব। বিদেশি সেনা ভূখণ্ড দখল করে বসে রয়েছে, অথচ দেশের প্রধান চুপ, অন্য কোনও দেশে এমন হত বলে ভাবা যায়?
কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী-সহ বিরোধীরা যখন ৫ মে-র পর থেকে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন, চিন ভারতের ভূখণ্ড কতটা দখল করেছে, সরকার টুঁ শব্দ করেনি। বরং এক গুরুত্বপূর্ণ, বর্ষীয়ান মন্ত্রী বেফাঁস কিছু বলে ফেলে আবার তা প্রত্যাহার করেন। অথচ এবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, চিন নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করেছে। তা হলে এত দিন কেন তা স্বীকার করা হয়নি? বিরোধীরা এ প্রশ্নও তুলেছেন, এত জন সেনার মৃত্যুর পরে বিদেশ মন্ত্রক কেন প্রায় ২০ ঘণ্টা বাদে প্রথম বিবৃতি দিল এবং তা-ও সাংবাদিকদের অবিরল প্রশ্নের পর ।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে,প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার স্থিতাবস্থার পরিবর্তন করার লক্ষ্যে চিন সচেষ্ট হয় ১৫ জুন রাতে। তার ফলাফল, হিংসাত্মক সংঘর্ষ। চিন দু’দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের তৈরি চুক্তি পালন করলে দু’পক্ষেরই প্রাণহানি এড়ানো যেত। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবের মন্তব্য, সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে জট ছাড়াতে ভারত সংকল্পবদ্ধ। ভারতের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, যে প্রাণহানি হয়েছে, তার তুলনায় কেন্দ্রের পাল্টা জবাব অনেকটাই নরম সুরে বাঁধা।