প্রচুর প্রচেষ্টার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে উদ্ধারকারী দল। এরপর ধ্বংসস্তূপ টপকে শ্রমিকদের অ্যাডভান্স লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুল্যান্স, স্ট্রেচার এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাধ্যমে এক এক করে বাইরে বের করে আনা হয়। সকলেই সুস্থ আছে বলে প্রাথমিক খবর।
১২ নভেম্বর থেকে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটকে ছিলেন যে ৪১ জন শ্রমিক, তাদের মধ্যে ৩ জন পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকও ছিলেন। এই ক’দিনে বিভিন্ন পথে চলেছে উদ্ধারকাজ। প্রথমে সুড়ঙ্গের সামনের দিক থেকে অংশটিতে খোঁড়া হচ্ছিল। কিন্তু, শুক্রবার খননযন্ত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে এগোতে হয়েছে উদ্ধারকারীদের। আর তাতেই মিলেছে সাফল্য।
২৮ নভেম্বর, মঙ্গলবার দুপুর বেলায় মনে হয়েছিল এক্ষুণি বেরিয়ে আসবেন উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকেরা। কিন্তু, সূর্য ডুবতেই বোঝা গেল শ্রমিকদের উদ্ধারে লাগবে আর মাত্র কিছুক্ষণ। যন্ত্র নয় মানুষের হাত ধরেই ১৭ দিন ধরে সুড়ঙ্গে বন্দি থাকা যে দুজন শ্রমিক মুক্ত আকাশের তলায় এসেছেন তাঁরা দুজনেই ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। বাইরে বেরোতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি কে সিংহ তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধ জেতার স্বীকৃতি। বাইরে তখন শোনা যাচ্ছে বাজির শব্দ। ততক্ষণে ঘড়িতে ৩৮৬ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে।

FILE- People watch rescue and relief operations at the site of an under-construction road tunnel that collapsed in mountainous Uttarakhand state, India, Wednesday, Nov. 15, 2023. All 41 construction workers who were trapped have been pulled out after 17 days, on Tuesday, Nov. 28. The efforts to reach the workers, aided by international tunneling experts and spearheaded by multiple Indian rescue agencies, was one of the most significant and complicated rescue operations in India’s recent history. (AP Photo/File) Source: AAP / AP
একদিকে যেমন উলম্বভাবে খনন করা হয়েছে তেমনই র্যাট-হোল মাইনিং কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। আর তাতেই মিলেছে সাফল্য।
অন্যদিকে, টানা ১৭ দিন বাইরের দিনরাত্রির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটক পড়া ৪১ শ্রমিকের ভরসা বলতে ছিল মোবাইল, লিকুইড খাদ্য এবং পাইপ বাহিত অক্সিজেন। মাঝে মাঝে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন শ্রমিকেরা। টেলিভিশনের তাদের উদ্ধারকাজ কতদূর এগিয়েছে, তার খোঁজ নিচ্ছিলেন পরিবারের কাছে। আর ছিল এনডিআরএফ-এর আশ্বাস।
তবে বহু দিন অন্ধকূপের মধ্যে থাকার পর হঠাৎ বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে শ্রমিকেরা কীভাবে নিজেদের মানিয়ে নেবেন তা চিন্তার বিষয় ছিল। তাই আশার আলো দেখা দিতেই সুড়ঙ্গের বাইরে পৌঁছায় ৪১টি অ্যাম্বুল্যান্স। পাশাপাশি সেখানে অস্থায়ী একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও গড়া হয়। সেই কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসার পর শ্রমিকদের ৩০ কিলোমিটার দূরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। যেতে যাতে বেশি সময় নষ্ট না হয়, তাই তৈরি করা হয়ে ছিল গ্রিন করিডোরও। জেলা হাসপাতালের পাশে অস্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরি করে চিনুক কপ্টারের ব্যবস্থা রাখা ছিল। শরীরের পাশাপাশি মনের চিকিৎসাও চলবে শ্রমিকদের। পাশাপাশি শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ চশমাও। কারণ, এতদিন তাঁরা অন্ধকারের মধ্যে ছিলেন, তাই হঠাৎ আলো দেখে তাদের চোখ খারাপ হওয়ার সমস্যা হতে পারে।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা, দিনভর উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গের বাইরে প্রতীক্ষায় ছিলেন আটক শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের মতোই অসহায় আলো দেখার অপেক্ষায় ছিলেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি এবং কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী জেনারেল ভিকে সিং।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই সুড়ঙ্গের বাইরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরা। অন্যদিকে, উদ্ধারকাজ যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, তাই সুড়ঙ্গের বাইরে প্রার্থনায় বসেছিলেন সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ অস্ট্রেলিয়ার আর্নল্ড ডিক্স। এই সুড়ঙ্গ খননের কাজের তিনিই রূপকার। তাঁর পুজোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, সুড়ঙ্গের বাইরে রয়েছে একটি ছোট অস্থায়ী মন্দিরে পুরোহিতের সঙ্গে পুজোয় বসেছেন আর্নল্ড ডিক্স। প্রার্থনা করেছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিও।

This handout photo provided by the Uttarakhand State Department of Information and Public Relations shows Pushkar Singh Dhami, right, Chief Minister of the state of Uttarakhand, greeting a worker rescued from the site of an under-construction road tunnel that collapsed in Silkyara in the northern Indian state of Uttarakhand, India, Tuesday, Nov. 28, 2023. Dhami said eight workers were rescued so far on Tuesday. The laborers are being pulled out through a passageway made of welded pipes which rescuers previously pushed through dirt and rocks. (Uttarakhand State Department of Information and Public Relations via AP) Source: AAP / AP
আর, শেষ পর্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতি র্যাট-হোল মাইনিং কৌশলেই উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটক ৪১ শ্রমিকের উদ্ধারকাজ সম্ভব হয়েছে। মেঘালয়ের খনিগুলিতে এই বিপজ্জনক প্রক্রিয়ায় খনন চলে। এই কৌশলে মাত্র একজন ব্যক্তি নামার মতো গর্ত খোঁড়া হয়। এরপর দড়ি বা বাঁশের মই ব্যবহার করে গর্তে নেমে বেআইনিভাবে বেলচা দিয়ে ঝুড়িতে কয়লা তোলেন শ্রমিকরা। রয়েছে সাইড কাটিং পদ্ধতি। এর জন্য পাহাড়ের ঢালে সরু সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। এবং বক্স-কাটিং পদ্ধতি, এক্ষেত্রে ১০ থেকে ১০০ বর্গ মিটারের একটি আয়তাকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। সেখানে উল্লম্বভাবে গর্ত খনন করা হয়, যা ২০০ ফুট অবধি গভীর হতে পারে। ঠিক ইঁদুরের গর্তের আকারে একাধিক অনুভূমিক সুড়ঙ্গ খনন করা হয়।
কিন্তু, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে ব়্যাট-হোল মাইনিং পদ্ধতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল। উত্তরকাশীতে র্যাট-হোল মাইনিং-এর জন্য সোমবার ডেকে আনা হয়েছিল খনি বিশেষজ্ঞদের।
১২ জন শ্রমিক সেখানে কাজ করেছেন। আর মঙ্গলবার রাতে স্ট্রেচারে করে শুয়ে পাইপের মাধ্যমে ৪১ জন শ্রমিককে একে একে বাইরে বের করে আনা হয়েছে। পাইপটি ছিল আড়াই ফুট চওড়া। পাইপের যে সব জায়গায় ঝালাই হয়েছে, সেগুলি ছিল বেশ ধারালো। সেখান দিয়ে বেরোনোর সময় আঘাত লাগতে পারে শ্রমিকদের, ঝুঁকির কথা ভেবে স্ট্রেচারের ওপর বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল।





