এক পোস্টে কবীর সুমন লিখেছেন, তাঁর মৃতদেহ যেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে দান করা হয়। কোনও স্মরণসভা, শোকসভা, প্রার্থনাসভা যেন না হয়। তাঁর সমস্ত পাণ্ডুলিপি, গান, রচনা, স্বরলিপি, রেকর্ডিং, হার্ড ডিস্ক, পেনড্রাইভ, লেখার খাতা, প্রিন্ট আউট যেন কলকাতা পুরসভার গাড়ি ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেগুলি ধ্বংস করার জন্য। কবীর সুমনের কোনও কিছু যেন তাঁর মৃত্যুর পর পড়ে না থাকে। তাঁর ব্যবহার করা সব যন্ত্র, বাজনা, সরঞ্জাম যেন ধ্বংস করা হয়। এর অন্যথা হবে তাঁর অপমান। লিখেছেন যে, সকলের অবগতির জন্য তাঁর ওই পোস্ট।
উনিশ শ’ নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবাম দিয়ে বাংলা আধুনিক গানের জগতে আবির্ভাব হয়েছিল কবীর সুমনের। প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি। মোড় ঘোরানো আধুনিক বাংলা গানের জনক হিসাবে তাঁকেই গ্রহণ করেছিল বাঙালি। কালক্রমে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। জড়িয়ে পড়েন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে। পরে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদও হন। তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে একটা সময় টানাপোড়েন চললেও আপাতত তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থক এবং বিজেপি-র কড়া বিরোধী।
সত্তর পেরনো কবীর সুমন এই মুহূর্তে বাংলা খেয়ালচর্চায় মনোনিবেশ করেছেন। আধুনিক গানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা বয়ে আনা রচয়িতার কথায়, সুরে তৈরি হচ্ছে সময়োপযোগী অসামান্য কিছু খেয়াল। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত নতুন নতুন খেয়াল তৈরির খেয়ালে মজেছেন। যে কোনও অনুষ্ঠানেই স্পষ্ট ঘোষণা করেন, বাকি জীবনটা তিনি বাংলা খেয়ালের জন্য কাজ করবেন, রেখে যাবেন নিজের সৃষ্টি। আর তার প্রবহমানতা ধরে রাখবেন ছাত্রছাত্রীরা, এই তাঁর ইচ্ছে।জীবনের অনেকটা অংশে বেশ কিছু বিতর্ক সঙ্গী কবীর সুমনের। ব্যক্তিগত অথবা রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। মেধা আর প্রজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গিতে সামলেছেন সেসব। বাংলা খেয়াল নিয়েও সমস্ত সমালোচনাকে হেলায় তুচ্ছ করে চালিয়ে গিয়েছেন সাধনা।
কিন্তু এমন কী ঘটল যে আচমকা কবীর সুমন ঘোষণা করে দিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত পাণ্ডুলিপি, গানের স্বরলিপি, রেকর্ডিং এমনকী বাদ্যযন্ত্রও ধ্বংস করা হোক? এই জিজ্ঞাসা ঘনিষ্ঠজন থেকে অনুরাগী, সকলেরই। তবে কি কাফকার পথে হেঁটেই কবীর সুমনের এই ইচ্ছাপ্রকাশ? মৃত্যুর পর সমস্ত কাজ ধ্বংসের ভাবনা কি সত্যিই কোনও দার্শনিক উপলব্ধিজাত নাকি নাগরিক কবিয়ালের এ এক অভিমান?
রোগশয্যায় শুয়ে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ফ্রানজ কাফকা প্রিয় বন্ধুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত সৃষ্টি যেন ধ্বংস করে ফেলা হয়। জীবনের শেষ অনুরোধটি রাখেন নি কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রড। যক্ষ্মায় অকাল প্রয়াত কাফকার মৃত্যুর পর ম্যাক্স তাঁর সমস্ত লেখা প্রকাশ করেছিলেন। তাতেই মেটামরফোসিস-এর স্রষ্টার দর্শনবোধ, সাহিত্যরসের হদিস মিলেছিল। সংবেদনশীল মানুষের এমন ভাবনা কি কেবলই অভিমান নাকি কোনও দার্শনিক উপলব্ধি,এই প্রশ্ন কিন্তু আবারও উসকে দিয়েছেন বাংলা আধুনিক গানের অন্যতম সংগীতকার- গায়ক কবীর সুমন।