অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চলে যান ভারতে। সেখানে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে; সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার। ভারত সরকার ২০১৪ সালে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে।
বাংলার অধ্যাপকের পরিচয় ছাপিয়ে সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সংকটকালে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের জন্য অনন্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অনেকের চোখে তিনি ছিলেন ‘জাতির বিবেক’।
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনিসুজ্জামানের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা সংস্করণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার আনিসুজ্জামান ছিলেন ১৯৯১ সালে গঠিত গণআদালতে অভিযোগকারীদের একজন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন উত্তাল পূর্ব বাংলা, সেই সময় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন আনিসুজ্জামান।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঠিক করা হয়, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য, সচেতন করার জন্য একটা পুস্তিকা প্রকাশিত হবে। প্রথমে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিপ্লবী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার ওপর। কিন্তু তিনি সময়ের অভাবে লিখতে পারেননি। তখন তা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় কিশোর আনিসুজ্জামানকে। ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ শিরোনামে সেই পুস্তিকা লিখেছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর এটাই ছিল প্রথম পুস্তিকা।
১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধচারণ করে যে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ততোদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।১৯৬৫ সালে ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল' বিষয়ে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৭ সালে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার। এর প্রতিবাদে বিবৃতিতে বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান।১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামে তিনিও পুরোপুরি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সেখানে তিনি প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন আনিসুজ্জামান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রূয়ারিতে আনিসুজ্জামানের ডাক পড়ে দেশের সংবিধান তৈরির কাজে। সংবিধানের ইংরেজি খসড়া তৈরি হয় কামাল হোসেনের নেতৃত্বে, বাংলায় অনুবাদ করেন আনিসুজ্জামান।