হাইলাইটস
- জঙ্গলঘেরা ৪ টি গ্রামের বাড়িঘর, কফির বাগান হাজার হাজার টন পাথর এবং কাদার স্তূপের নীচে
- ভূমিধসে হারিয়ে যাওয়া চুরালমালা, মুন্ডাক্কাই, অট্টামালা এবং নুলপুঝা গ্রামের নিখোঁজদের সন্ধান
- ধস নিয়ে সতর্কতাতেও ব্যবস্থা নেয়নি কেরল সরকার, অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ
- কেরলের ওয়েনাডে ভূমিধসের পরিস্থিতিতে শোকবিহ্বল বিশ্ব, পাশে থাকার বার্তা
এখনও প্রায় দু’শতাধিক মানুষ নিখোঁজ। স্থানীয়দের মতে, নিখোঁজদের জীবিত থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। পাহাড়ি ওই এলাকায় ভূমিধসের কারণে হাজার হাজার টন পাথর এবং মাটির যে স্তূপ তৈরি হয়েছে, তা খুঁড়ে উদ্ধারের কাজ চালানো খুব কঠিন বলে ওয়েনাড জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। একটি উদ্ধারকারী দলের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ি নদীর জলস্ফীতির কারণে আটকে পড়া কয়েক জন গ্রামবাসীকে দড়ি এবং কাঠের অস্থায়ী ভেলার সাহায্যে উদ্ধার করেছেন।
এখন যা অবস্থা তাতে ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের ভারত মহাসাগর প্রায় লাগোয়া রাজ্য কেরলের পশ্চিমঘাট পর্বতের জঙ্গলঘেরা গোটা চারেক গ্রাম কার্যত নিশ্চিহ্ন। বাড়িঘর, কফির বাগান হাজার হাজার টন পাথর এবং কাদার স্তূপের নীচে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য্যর কারণে কেরলকে বলা হয় ঈশ্বরের আপন দেশ। সেখানেই দু’দিন আগে প্রবল বৃষ্টি এবং প্রবল ভূমি ধসের পর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যেই সেনাবাহিনীর কর্মী, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, কেরলের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মী, রাষ্ট্রীয় জরুরি পরিষেবার কর্মী এবং স্থানীয় জনগণ উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রবল বর্ষণ, পায়ের তলায় এবড়ো-খেবড়ো মাটি। পা রাখাই দায়। সেই সব প্রতিকূলতা কাটিয়েও রাতভর কেরলের ওয়েনাডে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে জরুরি পরিষেবার কর্মীরা এবং স্থানীয় জনগণ। উদ্ধারকাজ যত এগোচ্ছে ততই যেন স্পষ্ট হচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। ধ্বংসস্তুপ সরালেই উদ্ধার হচ্ছে লাশ। এখনও প্রায় দু’শতাধিক মানুষ নিখোঁজ। স্থানীয়দের মতে, নিখোঁজদের জীবিত থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখনও পর্যন্ত মৃত অবস্থায় যাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ৭৭ জন পুরুষ, ৬৭ জন মহিলা এবং ২২টি শিশু রয়েছে। এঁরা সবাই ভূমি ধসে আক্রান্ত ওই চারটি গ্রামের বাসিন্দা। কেরল সরকার জানিয়েছে, মুন্ডাক্কাই, মেপ্পাড়ি এবং চুরামালা এলাকায় মৃতদের মধ্যে ৯৭ জনকে শনাক্ত করা গিয়েছে।

Health workers carry the body of a landslide victim to the morgue on the second day of the rescue mission following Tuesday's landslides at Meppadi, Wayanad district, Kerala state, India, Wednesday, July 31, 2024. (AP Photo/Rafiq Maqbool) Source: AP / Rafiq Maqbool/AP
কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছেন, দু’দিনের অভিযানে দেড় হাজার জনের বেশি মানুষকে নিরাপদে সরানো গিয়েছে। কঠিন পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, কেরল রাজ্য এমন বেদনাদায়ক দৃশ্য আগে কখনও দেখে নি। বিপর্যয়ের সম্ভবত এখানেই শেষ নয়। মৌসম ভবন জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবারও ওয়েনাডের আশাপাশে প্রবল বর্ষণ হতে পারে। ফলে বিপর্যয় আরও বাড়তে পারে।
কেরলের ওয়ানাডে ভূমিধসের পরিস্থিতিতে শোকবিহ্বল বিশ্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে শোকবার্তা জানিয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়া, মালদ্বীপ থেকে শুরু করে অন্যান্যরা। কঠিন সময় ভারতকে সমবেদনা জানিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে মালদ্বীপ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু শোকবার্তা পাঠিয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়াও। ওয়েনাডের ভূমিধসে শোকজ্ঞাপন করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বার্তায় লিখেছেন, কেরলের ওয়েনাডে ভয়াবহ ভূমিধসে রাশিয়া মর্মাহত। এই কঠিন সময়ে রাশিয়া ভারতের পাশে রয়েছে। ভারতের এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকাও। মার্কিন বিদেশ দফতরের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, কেরলের ওয়েনাডে ভয়াবহ ভূমিধস হয়েছে। এই ঘটনায় আমেরিকা গভীরভাবে শোকাহত। মৃতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা রয়েছে। যাঁরা নিখোঁজ রয়েছেন তাঁদের যেন দ্রুত উদ্ধার করা হয়। ওয়েনাডের বিপর্যয়ে শোকজ্ঞাপন করেছে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইরানের দূতাবাস। এক্স হ্যান্ডেলে জানানো হয়েছে, ইরান কেরলের মানুষদের পাশে রয়েছে।
এদিকে সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন, প্রবল বৃষ্টি এবং ভূমি ধসের সম্ভবনা সম্পর্কে আগেভাগেই সতর্ক করা হলেও, তবু ব্যবস্থা নেয় নি কেরল সরকার। রাজ্যসভায় তিনি জানিয়েছেন, কেরলে অত্যধিক বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। তার প্রভাবে যে ধস নামতে পারে, আগেই তা বোঝা গিয়েছিল। ধস নিয়ে অন্তত এক সপ্তাহ আগে সতর্ক করা হয়েছিল কেরল সরকারকে। এমনকি, কেন্দ্র থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ন’টি দলকেও আগেভাগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেরলে। কিন্তু এত কিছু করা সত্ত্বেও সময়ে ব্যবস্থা নেয় নি কেরল সরকার। তা করা হলে প্রাণহানি কিছুটা হ্রাস পেত।
একইসঙ্গে বিপর্যয়ের সময়ে কেরলের পাশেই আছে কেন্দ্র, জানিয়েছেন অমিত শাহ। সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ জানিয়েছেন, সারা বিশ্বে এমন চারটি দেশ রয়েছে, যারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্তত এক সপ্তাহ আগে তা নিয়ে সতর্কতা জারি করতে পারে। ভারত তার মধ্যে অন্যতম। কেরলের ক্ষেত্রে সেই সুবিধা নেওয়া যায় নি। এদিকে, ওয়েনাডে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জর্জ কুরিয়ান। তিনি জানিয়েছেন, পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে এসেছেন তিনি, বলে জানান কুরিয়ান।
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন বৃহস্পতিবারই ওয়েনাডে যাচ্ছেন। সেখানে সর্বদলীয় বৈঠকেরও কথা রয়েছে। ভূমিধসে হারিয়ে যাওয়া চুরালমালা, মুন্ডাক্কাই, অট্টামালা এবং নুলপুঝা গ্রামের নিখোঁজদের সন্ধান এবং ভিটেমাটি হারানো বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে সর্বদল বৈঠকে আলোচনা হবে বলে সরকারি সূত্রের খবর। দু’দিনের অভিযানে মোট এক হাজার ৫৯২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকারী দলগুলি সমন্বয় রেখে অক্লান্তভাবে কাজ করে গিয়েছে বলেই এই সাফল্য মিলেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন জানিয়েছেন, বিপদের আশঙ্কায় মোট ৬৭টি পরিবারের ২০৬ জনকে তিনটি আশ্রয়স্থলে পাঠানো হয়েছে।
এরই মধ্যে দিল্লি থেকে ইতিমধ্যেই ওয়েনাডে রওনা দিয়েছেন ওয়েনাডের সদ্য প্রাক্তন সাংসদ এবং দেশের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এবং আসন্ন উপনির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। বৃহস্পতিবারই ওয়েনাডের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন তাঁরা। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওয়েনাড এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। জারি করা হয়েছে কমলা সতর্কতা। সেই সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে ওয়েনাডের উপর দিয়ে। কোথাও কোথাও সেই হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০/৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে। দুর্যোগ এবং ভারী বৃষ্টির সতর্কতার কারণে কেরলের বিভিন্ন জেলায় বন্ধ স্কুল-কলেজ। রাজ্যে দু’দিনের শোক পালনের ডাক দিয়েছে পিনারাই বিজয়নের সরকার। অন্য দিকে, ধসের কারণে রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয়। বেশিরভাগ জায়গায় রাস্তা ধসে গিয়েছে। ফলে পুলিশ-প্রশাসন, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে উদ্ধারকাজে বেগ পেতে হচ্ছে।






