ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, ৫৪২টি আসনের মধ্যে ২৪০টিতে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। ৯৯টি আসনে জয় পেয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। অন্য দলগুলোর মধ্যে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৩৭টি, তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি, ডিএমকে ২২টি, তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ১৬টি, জনতা দল (জেডি-ইউ) ১২টি, শিবসেনা (উদ্ধব) নয়টি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) সাতটি ও শিবসেনা (এসএইচএস) সাতটি আসনে জয় পেয়েছে।
তৃতীয়বার সরকার গড়তে নরেন্দ্র মোদীকে প্রয়োজন জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার এবং তেলুগু দেশম পার্টির প্রধান চন্দ্রবাবু নায়ডুকে। অন্যদিকে, দেশে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া উঠতেই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমারকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছে ইন্ডিয়া জোট। সেক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানও ইন্ডিয়া জোটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ২৯ টি আসন থাকলেও নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নায়ডু হয়ে উঠেছেন ফ্যাক্টর এন।
ভোটের আগে জাতীয় রাজনীতিতে চর্চায় উঠে আসা অযোধ্যায় রাম জন্মভূমিতে ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপি। চলতি বছরে অযোধ্যায় যে রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠা করে রামরাজ্য গড়ার ডাক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অষ্টাদশ লোকসভার ফল ঘোষণা হতেই দেখা গিয়েছে সেই অযোধ্যাতেই জিততে পারে নি বিজেপি।

Chief Minister of India's West Bengal state and Trinamool Congress (TMC) party leader Mamata Banerjee addresses the media after a win in most seats in the Lok Sabha election 2024 in the state of West Bengal. (Photo by Dipayan Bose / SOPA Images/Sipa USA) Source: AAP / Dipayan Bose / SOPA Images/Dipayan Bose / SOPA Images/Sipa USA
বস্তুত, ২০০৪ সালের অটলবিহারী বাজপেয়ীর পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে। তবে সেবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেসের মনমোহন সিং। অবশ্য এবার ততটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
২০০৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ১৩তম লোকসভা ভেঙে যাওয়ার একদিন আগে বিজেপি সাংসদদের বেশিরভাগই দাবি করেছিলেন এনডিএ ক্ষমতায় ফিরছে। ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে অটলবিহারী বাজপেয়ী এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, মেয়াদ শেষের ছ’মাস আগেই ২০০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লোকসভা ভেঙে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর রেকর্ড করা টেলিফোন-বার্তা, ইন্ডিয়া শাইনিং প্রচারাভিযান দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষ রায় দেন কংগ্রেসের পক্ষে। তখন বিজেপির ইন্ডিয়া শাইনিং ক্যাম্পেইন মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
সেই দৃশ্যের কিছুটা পুনরাবৃত্তির দেখা গিয়েছে চলতি লোকসভা নির্বাচনে। এবারের মোদী'র গ্যারান্টি ক্যাম্পেইন সাফল্য এনে দিতে পারে নি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। যেখানে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা এনডিএ-র ৪০০ পারের স্লোগান তুলেছিলেন, সেখানে বিজেপির সংসদের নিম্নকক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতছাড়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ ২০২৪-এ সরকার গঠন করতে পারলেও, লোকসভার অন্দরে জোর টক্কর দেওয়ার জায়গায় রইল বিরোধী ইন্ডিয়া জোট।

NEW DELHI, INDIA - JUNE 4: Congress Parliamentary Party (CPP) Chairperson Sonia Gandhi along with party president Mallikarjun Kharge and party leader Rahul Gandhi during the address a press conference on Lok Sabha election result at AICC HQ on June 4, 2024 in New Delhi, India. The BJP-led NDA coalition led in a majority of seats but faced a stronger challenge from the opposition than expected. The BJP is likely to win around 240 Lok Sabha seats while the opposition INDIA bloc could win around 232 seats. (Photo by Raj K Raj/Hindustan Times/Sipa USA) Source: AAP / Hindustan Times/Hindustan Times/Sipa USA
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আদর্শগত ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে, ভোটগণনার মধ্যে মন্তব্য করেছে কংগ্রেস। এর মধ্যে, ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদীতে চিড় ধরলেও লোকসভায় জয়ের হ্যাট্রিক করতে চলেছে এনডিএ জোট। তবে ভাঙে নি উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলির মিথ। রেকর্ড মার্জিনে জয়ী হয়েছেন গান্ধী পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম রাহুল গান্ধী। চার লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে তিনি হারিয়েছেন বিজেপি প্রার্থীকে। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, সনিয়া গান্ধীর পর রাহুল গান্ধীকেও জয়ে স্বাগত জানিয়েছে সাই নদীর তীরে রায়বরেলির বাসিন্দারা। ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস ছাড়া বিকল্প কাউকে ভাবেনই না রায়বরেলির ভোটাররা। ফিরোজ গান্ধী দিয়ে শুরু, শেষ ২০১৯ এর ভোটে সনিয়া গান্ধী। অন্যদিকে, কেরালার ওয়ানডে-র পুরোনো আসনেও জয়ী হয়েছেন রাহুল গান্ধী।
এরপরই, গরিব মানুষই বাঁচিয়ে দিয়েছে দেশের সংবিধানকে, ইন্ডিয়া জোটের নির্বাচনী ফল নিয়ে মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। দিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠকে রাহুল গান্ধী বলেছেন, এই নির্বাচনের সব থেকে বড় বিষয় হল দেশবাসী একজোট হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এবারের ভোটে কংগ্রেস বা ইন্ডিয়া জোট শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করে নি; ইডি, সিবিআইয়ের অপব্যবহারের বিরুদ্ধেও লড়েছে। এই লড়াই ছিল সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। দরিদ্র, দলিত, কৃষকরা সংবিধান বদলের ষড়যন্ত্রের চেষ্টা বিফল করে দিয়েছেন।
এরমধ্যে, দেশে সরকার গঠনের দাবি জানানোর আগে জোট শরিকদের বক্তব্য শুনতে চায় কংগ্রেস। তাহলে কি সরকার গড়ার কথাও ভাবছে কংগ্রেস? সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে রাহুল গান্ধী বলেছেন, বুধবার ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে যা সিদ্ধান্ত হবে, সেটাই মেনে চলবেন তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, ইন্ডিয়া জোটের সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল। কারণ, তেলুগু দেশম পার্টি এবং নীতীশ কুমারের জেডিইউ- দুই দলই অতীতে কংগ্রেসের জোটসঙ্গী ছিল।

PATNA, INDIA - JUNE 4: Lok Janshakti Party (Ramvilas) supporters celebrating the party's lead in the Lok Sabha election at S.K. Puri on June 4, 2024 in Patna, India. (Photo by Santosh Kumar/Hindustan Times/Sipa USA) Source: AAP / Hindustan Times/Hindustan Times/Sipa USA
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, নীরব বিপ্লব রান্না ঘরে? নারী শক্তির উত্থান কি বদলে দিল ভারতের ভোট রাজনীতি। মঙ্গলবার ভোটগণনার শুরু থেকেই প্রচলিত ধরনের বাইরে গিয়ে যেভাবে বিজেপি তথা এনডিএ নেতাদের এতদিনের দাবির থেকে ফল খারাপ হয়েছে, তাতে স্পষ্ট নীরব বিপ্লব হয়ে গিয়েছে অন্তঃপুরে। এবারের ভোট নারী শক্তির উত্থানের কথা বারবার বলেছেন নরেন্দ্র মোদী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধীরা। মহিলাদের মন জয়ে এবং সশক্তিকরণে একগুচ্ছের প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছিল কংগ্রেস থেকে বিজেপি। কংগ্রেসের বছরে এক লাখ টাকা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এবং বিজেপির লাখপতি দিদির প্রভাব পড়েছে এবারের ভোটে।
মোট ভোটারের সংখ্যানুপাতে প্রায় অর্ধেক মহিলারাই এবারের ভোটে ছিলেন নির্ণায়ক শক্তি। আর তাদের মন জয়েই শাসক বিজেপির চেয়ে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস যে অনেক এগিয়ে তা ভোটের প্রবণতায় স্পষ্ট। উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রথাগত আসনে যেভাবে কংগ্রেস জিতছে তাতে একটা জিনিস স্পষ্ট, মহিলাদের সঙ্গে সংখ্যালঘুরাও জাতীয় ক্ষেত্রে আস্থা রেখেছে কংগ্রেসের এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে শাসক দলের ওপর।





